এক বটবৃক্ষের ছায়ায়

এক বটবৃক্ষের ছায়ায়-Mifrahul-Uloom
এক বটবৃক্ষের ছায়ায়

এক বটবৃক্ষের ছায়ায়

( মাসিক নেয়ামত, শাইখুল ইসলাম সংখ্যা, রজব-শাবান ১৪৪২ হিজরী, মার্চ ২০২১ এ প্রকাশিত)
২০০৬ সালের এক সকাল।
এটি আমার জীবনের এক বরকতময় দিন।
নয়টা বা দশটার দিকে হাটহাজারী ডায়াবেটিক হাসপাতালের সামনে একটা মাইক্রো এসে থামলো। হাটহাজারী ডায়াবেটিক হাসপাতাল তখন হাটহাজারী কলেজ সংলগ্ন বিল্ডিংটির নীচ তলায়। সংকীর্ণ জায়গা। মানুষের অনেক ভিড়। শফি ভাই মাইক্রো থেকে নেমে এসে বললেন হুজুর এসেছেন। আপনাকে দেখাতে চান। এক জায়গায় প্রোগ্রাম ছিলো। প্রোগ্রাম শেষে এখানে নিয়ে এসেছি।
আল্লামা শাহ আহমদ শফী সাহেব হুজুর! আমি এক দৌড়ে মাইক্রোর নিকটে পৌঁছে গেলাম। হুজুর নামবেন, ভিড়ের মধ্যে হাসপাতালে এসে বসবেন। হুজুরের কষ্ট হবে। আমি বললাম, রোগী দেখা শেষ করেই আমি মাদ্রাসায় আসছি। ইন শা আল্লাহ হুজুরের কামরায় গিয়ে হুজুরকে দেখবো। হুজুর যেন এখন মাদ্রাসায় চলে যান। এখানে হুজুরের কষ্ট হবে।
রোগী শেষ করে মাদ্রাসায় পৌঁছলাম। হুজুরের সুগার অনেক বেশি। চারশোর উপরে। ঔষধ অনেক খান। সুগার তেমন কন্ট্রোলে থাকে না। ডায়াবেটিস পুরোনো হয়েছে। ট্যাবলেটে তেমন কাজ হচ্ছে না।
হুজুরকে বিষয়টি বুঝিয়ে বললাম। ইনসুলিন লাগবে। আর এই কয়দিন আমি ইনসুলিন নিজে পুশ করবো। ইন শা আল্লাহ প্রতিদিন সকালে এবং রাতে। খাদেম ভাইয়েরা ইন শা আল্লাহ কয়েকদিনের মধ্যেই শিখে ফেলবে। তেমন কষ্ট হবে না। হুজুর সহজে রাজী হলেন। অথচ রোগীরা এত তাড়াতাড়ি রাজী হয় না। হাসি হাসি চেহারায় বললেন, “ঠিক আছে। শফি! ডাক্তার সাহেবের জন্য খাবার রেডি করো। তিনি আমার সাথে খাবেন।”
হুজুরের সাথে খাওয়া। অনেক বড় সৌভাগ্য। এমন খাওয়া কে মিস করে?
এইদিনই হুজুরের সাথে প্রথম পরিচয়। প্রথম খাওয়া। এরপর কত খেয়েছি। কতবার হুজুর মুখে লোকমা তুলে দিয়েছেন। এই মহব্বত ও এই ভালোবাসা, এই আন্তরিকতা ও এই অকপটতা কি করে ভুলা যায়!
এরপর থেকে সম্পর্ক এমন পর্যায়ে পৌঁছলো হুজুরের ব্যক্তিগত চিকিৎসকই হয়ে গেলাম। একটু খারাপ লাগলেই হুজুর স্মরণ করেন। আমি দৌড়ে যাই। এই দৌড়ে যাওয়াকে সৌভাগ্য মনে করি। এমন বুজুর্গের সোহবতকে নিজের জীবনের জন্য পাথেয় মনে করি।
২০০৭ এর মাদ্রাসার বার্ষিক মাহফিল। হুজুরের কামরায় অনেক গণ্যমান্য ব্যক্তি এসেছেন। হুজুরের ইনসুলিন নেয়ার সময় হয়েছে। আমি কাছে থাকলে হুজুর আমাকে দিয়েই ইনসুলিন পুশ করাতে পছন্দ করেন। প্রথমবার যে আমিই দিয়েছি। আমি পুশ করলে নাকি হুজুরের ব্যথা লাগে না।
আমাদের চট্টগ্রাম শহরের এক মুরুব্বি আমাকে এখানে দেখে বললেন, ‘ মছিহ উল্লাহ! তোমার এত বড় সৌভাগ্য! তুমি আল্লামা আহমদ শফি হুজুরের চিকিৎসা করো! তুমি হুজুরের এই সোহবত ছাড়বে না!’
বাস্তবেই দ্বীনে একটু একটু অগ্রসর হওয়া আওয়াম মানুষের জন্য এই ধরনের বুজুর্গ ব্যক্তির সোহবত দ্বীনের ক্ষেত্রে অগ্রসর হওয়ার ক্ষেত্রে টনিকের মতো। সদ্য ইলমে দ্বীন হাসিলের পথে যাত্রা শুরু করেছি। ঠিক এমন সময় এমন মানুষের কাছে যেতে পারা, সোহবতে থাকতে পারা কত বড় নিয়ামত।
একদিন সকালে হুজুরকে দেখতে গিয়ে বায়আতের দরখাস্ত করলাম। হুজুর নিজের হাতে আমার হাতটা নিয়ে বড় আন্তরিকতার সাথে বায়আত করালেন। সেই হুজুরের মুখে মুখে বলা উচ্চারণগুলো মনে পড়ে। হুজুর আমার হাতটা নিজের দু’হাতে রেখে সবগুলো যিকর এক এক করে বলে লম্বা বয়ান করলেন। শেষে আমার জন্য খাস করে দোয়াও করলেন। এই স্মৃতিগুলো কি ভুলা যায়? একদিন নাস্তার প্লেট থেকে সবগুলো আঙ্গুর এবং কলা একটা প্যাকেটে ঢুকিয়ে বললেন, এই সব আপনার বিবি ও বাচ্চাদের জন্য হাদিয়া। কত আন্তরিক ও ভালোবাসায় ভরা ছিলো সেই হাদিয়া।
হুজুরকে নিজের দ্বীনি পড়াশুনার কথা শুনাই। হুজুর খুশি হন। দিল থেকে দোয়া করেন। আহ! এভাবেই ২০০৮, ২০১০, ২০১২, ২০১৩ এর সেই উত্তাল সময়!
একদিন শেষরাতে হুজুরের সুগার পড়ে গেলো। হুজুর সেন্সলেস হয়ে গেলেন। এম্বুলেন্সে করে হাটহাজারীস্থ আলিফ হাসপাতালে নিয়ে গেলাম। ২৫% ডেক্সট্রোজ দিয়েও অনেকক্ষণ পর্যন্ত জ্ঞান ফিরলো না। এম্বুলেন্সে করে রওয়ানা দিয়েছি সিএসসিআর এর দিকে। পথে হুজুরের শ্বাস-প্রশ্বাস বন্ধ, পালস নেই, হার্টবিট নেই। এমনকি পিউপিল ডায়ালেটেড। ভয় পেয়ে গেলাম। হুজুরের খাদেম শিব্বির, নাতি আরশাদ, সাথে আমি। হুজুর কি চলেই গেলেন? গাড়িতে আমাদের কান্নার রোল আর দোয়া। সিএসসিআর এ আইসিইউতে পৌঁছতেই হুজুর চোখ মেলে তাকালেন। আমি চুড়ান্ত অবাক। এ কি দেখলাম? আমার এক্সামিনেশনে ভুল ছিলো, না সত্যিই আল্লাহ পাক হুজুরকে পুনরায় ফিরিয়ে দিয়েছেন?
মিশকাতের বছর এক রাতে স্বপ্নে দেখি হুজুর আমাকে ধমকাচ্ছেন। বলছেন, ” আমি অসুস্থ, তুমি আমাকে দেখতে আসছো না?” সকাল হতেই দৌড়ে গিয়ে দেখি হুজুরের চোখ উঠেছে। কনজাংটিভাইটিস। প্রয়োজনীয় ঔষধ লিখে দিতে দিতে স্বপ্নের কথা বললাম। হুজুর হাসলেন। সেই হাসি যেন এখনও জীবন্ত।
হুজুরের দারসগুলোর কথাও মনে পড়ে। একজন বয়োবৃদ্ধ উস্তাদকে কিভাবে ছাত্ররা মান্য করে, কী পরিমাণ আজমত ও শ্রদ্ধাপূর্ণ ভয় নিয়ে ছাত্ররা দারসে শরীক হয় তা এই যুগের বিরল দৃশ্যগুলোর একটি। একদিনের ঘটনা।
সহীহ বোখারীর দরস চলছে। হাজারের অধিক ছাত্র দরসে উপস্থিত। পুরো দারুল হাদীস যেন আসমানী ইলমের ছায়ায় আচ্ছাদিত। দরসের মাঝে এক ছাত্রের অমনোযোগিতা হুজুরের নজর এড়ালো না। তিনি তাকে কাছে ডাকলেন। হাদীসে নববীর এই মজলিসে এমন অমনোযোগিতা তাকে পেরেশান করে তুলল। তিনি এর কৈফিয়ত তলব করলেন। যথোপযুক্ত কারণ না থাকায় তিনি রেগে গেলেন। ঐ ছাত্রকে বললেন, কান ধরে উঠবস কর। একান্ত বাধ্য ঐ ছাত্রটি কান ধরে উঠবস করতে লাগল। প্রায় পাক্কা পাঁচ মিনিট। হুজুর জানেন, তাঁর ছাত্র আদেশ পালনে ত্রুটি করবে না। অনুগত ছাত্রও জানে, প্রিয় উস্তাদের হুকুম পুরো করার মধ্যেই তার সফলতা। কোন প্রতিবাদ নেই, কোন দ্বিধা-সংকোচ নেই। তার উদ্দেশ্য তো মাওলাকে রাজী করা। উস্তাদের হুকুম কোন প্রশ্ন ছাড়াই পালনের মধ্যে সে তার সোনালী ভবিষ্যতকে দেখছে। হাজারের বেশি এক মজলিসে এভাবে কানে ধরে উঠবস করা কারো পক্ষে কি সম্ভব! জাগতিক শিক্ষার সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠেও পড়াশুনা করে এসেছি। কই, কোথাও তো উস্তাদকে এভাবে মানতে দেখি নি। বরং দেখেছি, উস্তাদকে রুমে অবরুদ্ধ করে রাখতে। দেখেছি প্রফেসরের রুমে তালা লাগিয়ে দিতে। দেখেছি শিক্ষকের গায়ে হাত তুলতে। দেখেছি শিক্ষকের হাত থেকে বেত কেড়ে নিতে। আর এখানে? হুজুর এই বয়সেও খুবই সচেতন, যেন কোন ছাত্র গাফেল না থাকে। একজনকে শাস্তি দিয়ে সবাই সচেতন করেন।
হুজুর সময়ের হেফাজত ও সময়কে কাজে লাগানোর তারগীব দিতেন। একদিন দারসে এই প্রসঙ্গে বললেন,’ জীবনে এক কাপ চা খাওয়ার মতো সময়ও কখনও বৃথা নষ্ট করি নি।’ শামায়েলে তিরমিজী পড়ানোর সময় রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর এক একটা উত্তম অভ্যাস সম্পর্কিত হাদীস আসতো, হুজুর আমাদের জিজ্ঞেস করতেন, ‘তোমরা এই সুন্নতের উপর আমল করো? ‘ আমাদের চেহারার দিকে তাকিয়ে আবার বলতেন, ‘ উহুঁ! মনে হয় না। তোমরা সুন্নতের উপর আমল করবা। আমল করার জন্যই তো এই কিতাব পড়াচ্ছি। আমল করবা তো?’
আমাদের মেডিকেলের জুনিয়র সাথীদের প্রায়ই মাদ্রাসায় হুজুরের কাছে নিয়ে আসতাম। জেনারেল লাইনে শিক্ষিত এই অল্পবয়সী দ্বীনদার ছেলেগুলোকে দেখে হুজুরও খব খুশী হতেন।
একবারের ঘটনা। আমাদের সিএমসির ৫৭তম ব্যাচের সদ্য মেডিকেলে ভর্তি হওয়া ছাত্রদের হুজুরের কাছে নিয়ে এসেছি। ফার্স্ট ইয়ারের এই এগারজনকে দেখে খুব খুশি হলেন হুজুর। পরনে সুন্নতি লিবাস, মাথায় টুপি, মুখে কখনও ক্ষুর না লাগানো সদ্য গজানো দাঁড়ি,চেহারায় নূরানি পবিত্রতা, মাত্র এই আটারো উনিশ বছর বয়সে দ্বীন সম্পর্কে জানা এবং মানার আগ্রহ যে কাউকে মোহিত করবেই। আর তাদের যেই দেখবে বুঝতে দেরি হবে না, এ সব তাবলীগের মেহনতেরই ফসল। হুজুর তাদের সংক্ষিপ্ত নসীহত করতে গিয়ে পুরো এক ঘন্টা কথা বললেন। তাও আবার এই উঠতি জোয়ানদের উপযোগী করে হাস্যরসের উপাদানসহ। জীবনে চলার পথে তাক্বওয়ার গুরুত্ব, নিয়তের প্রশস্ততার ফাযায়েল, পেশাগত সততা, খেদমতে খালকিল্লাহর গুরুত্ব, এখন থেকেই অল্প অল্প করে দ্বীন শেখার তারগীব, এমনকি দ্বীনদার মেয়ে বিয়ে করার প্রয়োজনীয়তার কথাও বিস্তারিত বললেন। এক কর্নেলের স্ত্রীর স্বামীকে সুন্নতের উপর তোলার জন্য প্রয়োগ করা হেকমতের কথা বললেন রসিয়ে রসিয়ে। ছাত্ররা খুব মজা পেলো। শেষে খুব অন্তর থেকে ছাত্রদের জন্য দোয়াও করলেন। হুজুর কথা প্রসংগে এক মিনিটের মাদ্রাসার কথা বললেন, যা যে কোন ইমাম সাহেব মসজিদে যে কোন নামাজের পর পর চালু করতে পারেন। বছরে ৩৬৫ দিনে ৩৬৫ মাসায়েল সহজেই শিখে নিতে পারবে মুসল্লীগন। কোরআন শুদ্ধ করার জন্য ইমাম সাহেবের কাছ থেকে সময় নেয়ার তারগীব দিলেন। বললেন, ইমাম সাহেব সময় দিতে বাধ্য। তার কাজ তো কেবল নামাজ পড়ানো নয়। সেই ছেলেগুলো মা শা আল্লাহ এখন ডাক্তার হয়েছে। এখন তারা দ্বীনের ক্ষেত্রে আরও আগে বেড়েছে। হুজুরের সেই নসীহতের কথা এখনও তারা কৃতজ্ঞতার সাথে স্মরণ করে।২০১৫ তে হজের জন্য টাকা জমা দিয়েছি। ফ্লাইট নিয়ে কি অনিশ্চয়তা! বার বার আশাহত হই। অন্তরে অস্থিরতা। গেলাম হুজুরের কাছে। হুজুরকে পেরেশানির কথা বললাম। হুজুর অভয় দিলেন। নিরাশ হতে নিষেধ করলেন। খুব দোয়া করলেন যেন এই অনিশ্চয়তা কেটে যায়। হুজুরের সেই অভয়বানী ও দোয়া শুনে এক আশ্চর্য শক্তি অন্তরে ফিরে পেলাম। মনে হলো, ইন শা আল্লাহ আল্লাহপাক মাহরুম করবেন না। ফ্লাইট নিশ্চিত হয় নি, তারপরও ঢাকায় হজক্যাম্প পর্যন্ত পৌঁছে গেলাম। অবশেষে শেষ পর্যন্ত ফ্লাইট কনফার্ম হলো। পৌঁছে গেলাম আল্লাহপাকের ঘরে। হজ শেষে ফেরার পর হুজুরের সাথে দেখা হওয়ার সেই দৃশ্য! কতই না খুশি হুজুর! আমি যে বায়তুল্লাহ থেকে এসেছি।
হুজুরের সাথে রমজানে ইতিকাফ করার স্মৃতি। যিকর ও দোয়ায় মুখরিত সেই জীবন্ত রমজান। ২০১৫ তে হুজুরের সাথে ইতিকাফের কথা মনে পড়ে। হুজুর তাঁর সাথে ইফতারিতে শরীক হওয়ার দাওয়াত দিতেন। আমার মুয়াজ ও মুসআব প্রায়ই মসজিদে আসতো। হুজুর তাদের আদর করে পাশে বসাতেন। ইফতারি নিজের হাতে তাদের মুখে তুলে দিতেন। তাদের জন্য দোয়া করতেন। সেই রমজানে আমার লেখা রোজনামচা এখনও সেই দিনগুলোর কথা মনে করিয়ে দেয়।
“জীবনের কিছু কিছু দিন অসম্ভব সুন্দর হয়। এ দিনগুলিই জীবনের সেরা সম্পদ। চোখ বন্ধ করলে তা হয়ে উঠে জীবন্ত । মনের রেটিনাতে, স্মৃতির এলবামে তা জেগে থাকে ঝলমল।অন্ধকার আকাশে তারার মতো তা মিটিমিটি করে জেগে থাকে সারারাত।
আমার জীবনের এই কয়েকটি দিন যেন তেমনই। রাব্বুল হায়াত যেন তাঁর অফুরন্ত ভান্ডার থেকে একান্ত করে এই দিনগুলি দান করেছেন। আসলে মাওলার দান এমনই, যদিও আমার মতো নালায়েকরা তার কদর করতে জানে না।
হজরত আছেন। তাঁর সান্নিধ্যে বসলে আখেরাতের স্মরণ তাজা হয়। সামান্য কথায়ও চোখে অশ্রু নামে। গত পরশু কিছুক্ষণের জন্য পাশে বসেছিলাম। মুরুব্বীদের জন্য ইসালে সাওয়াবের কথা মনে করিয়ে দিয়ে বললেন, ” তাঁরা আমাদের দিকে বড়ই কাতর চোখে তাকিয়ে আছেন।” আশ্চর্য এই এক কথাতেই নিজের চোখে অশ্রুর আভাস পেলাম। আল্লাহওয়ালাদের কথার এমনই তা’ছীর।
বায়তুল কারীমে আল্লাহর অলিদের সান্নিধ্যে কাটছে এই কটা দিন। প্রেমের বাজারে সওদা কিনতে এখানে অনেকেই হাজির হয়েছেন। ইউসুফকে কিনতে যাওয়া সেই নিঃস্ব বুড়ীর মতো আমিও এখানে বেডিং বিছিয়েছি। মাওলার দিকে দু’হাত তুলে ফুঁপিয়ে কান্নারত মানুষগুলো আমাকে বার বার জাগিয়ে তোলে। গাফলতির চাদর মুড়িয়ে ঘুমাবো আর কত কাল!”
২০১৮ ইংরেজি। কয়েকদিন পরেই হাইয়াতুল উলিয়ার অধীনে আমার দাওরা পরীক্ষা। কিন্তু পেরেশানির এক ব্যাপার ঘটেছে। আমার বিরুদ্ধে প্রত্যেক উস্তাদের কাছে বেনামী চিঠি এসেছে। পরীক্ষা দেয়া অনিশ্চিত। প্রবেশপত্র হাতে পাচ্ছি না। ওমর সাহেব হুজুর পরামর্শ দিলেন মুহতামিম সাহেব হুজুরকে গিয়ে বিস্তারিত জানাতে। দৌড়ে হুজুরের কাছে গেলাম। পুরো হালত জানালাম। হুজুর শুনামাত্রই বললেন, ‘ এটি তো কারও শয়তানি। আমি আজই মিটিং ডাকবো। আপনি চিন্তা করবেন না। ‘
হুজুর মিটিং ডাকলেন। সব হুজুরদের মতামত নিলেন। মুফতি নূর আহমাদ সাহেব হুজুর, মুফতি আব্দুস সালাম সাহেব হুজুর, বাবুনগরী সাহেব হুজুরসহ সবাই আমার পরীক্ষার রেজাল্ট ইত্যাদি বিবেচনায় পরীক্ষা দিতে দেয়ার পক্ষে রায় দিলেন। হুজুর সব শুনে নিজের নির্বাহী ক্ষমতাবলে সিগনেচার করে দিলেন,” অভিযোগ বাতিল, ডাক্তার মছিহউল্লাহ পরীক্ষা দেবে।’ হুজুরের দোয়া নিয়ে পরীক্ষা দিলাম। পরীক্ষায় মুমতায হলাম। হুজুর নিজের হাতে পূরস্কার দিলেন। কত যে খুশি হলেন। হুজুরের এত এত ইহসান কিভাবে ভুলি? কিভাবে ভুলি হুজুরের দারসের অনেক খন্ড খন্ড স্মৃতি। কত ডাক্তার, কত প্রফেসরের এসে এসে হুজুরের হাতে বায়আত হওয়া। জিন্দেগী বদলানো।
হুজুর এখনও আমাদের জন্য অনুপ্রেরণা। প্রতিদিন নূর মসজিদে ফজরের পর পরামর্শ শেষে মাকবারায়ে হাবিবীতে যেয়ারতের জন্য দাঁড়াই। এরপর হেঁটে হেঁটে চলে যাই দক্ষিণে। বামেই আমার বাসার গলি পড়ে। কিন্তু আমাকে আরও একটু সামনে যেতে হয়, না গিয়ে পারি না। ঠিক বায়তুল আতীকের সামনে গিয়ে পূর্বদিকে ফিরে দাঁড়াই । এখানেই প্রিয় উস্তাদ, প্রিয় শায়খ শুয়ে আছেন। দাঁড়ানো মাত্র একটা দৃশ্য মনে পড়ে। হুজুরের হাতের ভেতর আমার হাত। যিকরের সবকগুলো মুখে মুখে শিখিয়ে দিচ্ছেন। আমার দু’চোখ বেয়ে পানি পড়ছে। এই এখানে এই সময়েও চোখে নোনাজলের আভাস পাই। দিলের ভেতর থেকে প্রতিজ্ঞারা জেগে উঠে। ‘নাহ! আমাকে দ্বীনের উপর চলতে হবে। এই বুজুর্গদের উসীলায় সামান্য ইলম যা শিখেছি, তার হক আমাকে আদায় করতেই হবে। হে মাওলা! তুমি তাওফীক দাও।’
একজন আহমদ শফীর কথা কি বলে শেষ করা যায়? তিনি একটা বিরল ব্যক্তিত্ব, তিনি একটা ইতিহাস। কিন্তু পরিশেষে তিনি একজন মানুষই । মানুষ তো তার সব ধরনের দূর্বলতার সাথেই মানুষ।
হে মাওলা! হুজুরকে তুমি জান্নাতে উঁচু মকাম দান করো। ভুল-ত্রুটি ক্ষমা করে জান্নাতে মর্যাদা বুলন্দ করো।
আমাদের হুজুরের শেখানো রাস্তায় চলার তাওফীক দাও।